সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে আপনি কতটা সচেতন?

আমরা প্রত্যেকে কম-বেশি প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছি। শহর থেকে গ্রাম সবখানে তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লাগছে। আর্থিক লেনদনগুলো অনলাইনের আওতায় আসছে। এখন রাস্তার যানজট ঠেলে অফিসে না গিয়েও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অনলাইনের মাধ্যমে ঘরে বসে করা যাচ্ছে। অর্থাৎ বাসা থেকে রাস্তায় হেঁটে গিয়ে যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বহন করে নিয়ে যাওয়া লাগত, সেগুলো আমরা ইন্টারনেটের মধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছি। কম সময়ে কাজও হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কখনও কি ভেবেছেন যে ‘পথ’ দিয়ে আপনার গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো পৌঁছালেন সেটি কতোটা নিরাপদ? গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো আপনি ছাড়া অন্য কারও হাতে যাচ্ছে কিনা? হ্যাঁ, বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, আমরা যতো বেশি প্রযুক্তির সুবিধা নিচ্ছি, ততো ঝুঁকি।

সাধারণত প্রকাশ্যে দিবালোকে কিংবা অন্ধকারে ঘর-বাড়িতে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই হয়। কিন্তু কেউ যদি তা ঘরে বসে করার সুযোগ পায় তাহলে কেন অতো ঝামেলায় যাবে? প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে এসব অপকর্ম হতে পারে অনলাইনেই। আর এ ধরনের সাইবার অপরাধীদের কবলে পড়ার ক্ষেত্রে আমাদের অসচেতনতাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা বা গোপনীয়তার বিষয়ে সতর্ক থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা মনের অজান্তেই কতো জায়গায় ব্যক্তিগত কতো তথ্য দিয়ে বেড়াই যা মোটেই উচিৎ নয়।

বর্ডারলেস সাইবার ওয়ার্ল্ড: সাধারণত আমরা এক দেশ থেকে অন্য দেশের বর্ডার পার হতে পাসপোর্ট-ভিসা ইত্যাদির প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাইবার ওয়ার্ল্ড হলো বর্ডারলেস। ইন্টারনেটে সারা পৃথিবী এক, মাঝে কোনো সীমানা নেই। ইন্টারনেটের একক মালিকানা বা আধিপত্যে কেউ নেই। এখানে বলতে পারেন সবাই রাজা। সুতরাং আপনি যখনই কোনো তথ্য ইন্টারনেটে দিচ্ছেন, তখন সেটি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ছে। মনে রাখতে হবে যে, কোনো তথ্য যখন আপনি ইন্টারনেটে দিচ্ছেন, সেটি কোনো না কোনোভাবে তৃতীয় যেকোনো পক্ষের হাতে চলে যেতে পারে।

সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারে সচেতনতা: স্বাভাবিকভাবে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওয়েবসাইটে আমরা ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য উন্মুক্ত করে দেই। যেমন: জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, জন্ম তারিখ, ফোন নম্বর, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, শখের বিষয়, কখন কোথায় যাচ্ছি ইত্যাদি। তথ্যগুলোর প্রাইভেসি সেটিংসে ‘পাবলিক’ সেট করার কারণে আপনার বন্ধু তালিকায় নেই, এমন কেউ হয়তো এসব ব্যক্তিগত তথ্য দেখতে পাচ্ছে। সাইবার ওয়ার্ল্ডে আপনার ক্ষতি করার জন্য এসব তথ্য কাজে লাগাতে পারে অপরাধীরা।  অনেকে আবার অপরিচিতদের বন্ধু হিসেবে যুক্ত করছেন, যা উচিত নয়। অথবা এমনও হতে পারে যে আপনি যে আইডি পরিচিত ব্যক্তির দমনে করছেন সেটি আসলে তার আইডি নয়। অপরাধীরা অনেক সময় আপনার পরিচিত ব্যক্তির নাম-ছবি ব্যবহার করে ভূয়া আইডি ব্যবহার করতে পারে।

ডিভাইস ব্যবহার: মোবাইল, কম্পিউটার বা যেকোনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসে আমরা ইউজার-পাসওয়ার্ডসহ যতো ধরনের তথ্য ব্যবহার করছি সবই ওই ডিভাইসে সংরক্ষিত থাকছে এবং এগুলো উদ্ধার করা সম্ভব। বিশেষ সফটওয়্যার ও ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে যেকোনো তথ্য উদ্ধার করা যায়। সুতরাং অন্যের ডিভাইসে আপনি যাই ব্যবহার করছেন সবই কিন্তু অন্য কারও হাতে চলে যেতে পারে। আপনার ইমেইল, ফেসবুক আইডি বা যেকোনো অনলাইন অ্যাকাউন্ট লগইন বা একান্ত কোনো ব্যক্তিগত ছবি-তথ্য নিজের ডিভাইস ছাড়া অন্য কারও ডিভাইসে ব্যবহার করা একদমই উচিত নয়। এছাড়া নিজের ডিভাইসও অন্য কাউকে ব্যবহার করতে দেয়া উচিত নয়। কারন এক ডিভাইস থেকে অন্য ডিভাইসে তথ্য পাচার করতে খুব বেশি সময় লাগে না। আবার ডিভাইস হারিয়ে গেলে তাতে আপনার সংরক্ষিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য অন্যের হাতে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অনেক সময় আমরা নিজের কোনো ডিভাইস মেরামত করার জন্য বাইরে নিয়ে যাই। এ ক্ষেত্রে নিজের বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কারো কাছে ব্যক্তিগত ডিভাইস না দেয়াই ভালো।

অনলাইনে প্রলোভন: বিভিন্ন সময় ই-মেইলে পুরস্কার জেতার খবর পেয়েছেন? আজকাল লোভনীয় এ ধরনের ক্ষুদেবার্তা মোবাইলেও পাঠানো হচ্ছে। লটারি জেতা, ভিসা পাওয়া, গ্রিন কার্ড পাওয়া, পূঁজি ছাড়াই যৌথ ব্যবসার সুযোগসহ নানাভাবে আপনি লোভনীয় সুযোগের খবর জানতে পারেন। অথবা কেউ একজন তার খুব কষ্টের কথা জানালো। বিষয়টি এমন যে, বার্তা প্রেরক অনেক ধনী পরিবারের সন্তান। কিন্তু তিনি তার সম্পদ নিয়ে বেকায়দায় আছেন। এজন্য আপনার দেশে এসে আপনার সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। এ ধরনের নানাভাবে আপনাকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হতে পারে। এসব সুযোগের কথা বলে আপনার ব্যক্তিগত তথ্যগুলোর জানানোর অনুরোধ করে অপরাধী চক্র। আপনি ব্যক্তিগত তথ্যগুলো দিলেই সে কোনো না কোনোভাবে এগুলো কাজে লাগিয়ে আপনার অনলাইন অ্যাকাউন্ট হ্যাক করতে পারে। অথবা যেকোনো অপকর্মে আপনার তথ্য ব্যবহার করতে পারে, যার ফলে আপনি বড় কোনো বিপদে পড়তে পারে। তাই এ ধরনের যেকোনো কিছু থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আকর্ষনীয় কোনো ছবি বা কোনো ওয়েব লিংকে যাচাই না করে ক্লিক করা যাবে না। অসাবধানতার কারনে আপনার একটি ক্লিকেই সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে।

আসল কথা হলো আমরা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেখানে সেখানে দেয়ার ক্ষেত্রে সব সময়ই সতর্ক থাকতে হবে। একটা সময় ছিল যার কাছে যতো টাকা আছে তিনি ততো ধনী। কিন্তু এখন টাকার চেয়ে আরও একটি মূল্যবান বিষয় হলো ’তথ্য’। আপনার ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে কখন যে অপরাধীচক্র আপনার ক্ষতি করছে আপনি হয়তো সহজে টের পাবেন না। আর যখন পাবেন তখন হয়তো কিছু করার সুযোগ থাকবে না।